কাঠবিড়ালি নামক ছোট সুন্দর প্রাণীটা আমার শৈশবের একটা বড় জায়গা জুড়ে থাকায় আমি এদের ছোট বেলা থেকেই ভালবাসি। তাই যখন সুযোগ আসলো, বেছে নিলাম কাঠবিড়ালী নিয়ে গবেষণাকে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশে আন্তর্জাতিকভাবে বিপন্ন বলে চিহ্নিত বাঘ, হাতি নিয়ে শত শত গবেষণা থাকলে ও কাঠবিড়ালি নিয়ে গবেষণা কেবল এক অঙ্কের সংখ্যাতে সীমাবদ্ধ যার মাঝে বেশির ভাগই নামমাত্রে বা নিতান্তই নগণ্য উপাত্ত পরিবেশন করে শেষ করেছে।
কিন্তু কেন? কারন হচ্ছে এই খুদ্র,সর্বাঙ্গে সুন্দর প্রাণীটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্যা এমনকি মানুষের চিন্তাধারা ও মানসিকতার সাথে এত গভীর ভাবে সম্পর্কযুক্ত যে এই সমস্যাগুলোই একসাথে হয়ে এমন একটি পরিস্থিতির তৈরি করেছে যা আমরা বুঝতে ও পারিনি বা পারছিনা।তাই আমার গবেষণায় আমি খুঁজে বের করতে চেয়েছি বাংলাদেশে কাঠবিড়ালী নিয়ে এত কম গবেষণা হওয়ার কারণ এবং কিভাবে কাঠবিড়ালী নিয়ে গবেষণা বাড়ানো যায় সেই পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের সম্ভাব্য পদক্ষেপসমূহ। প্রশ্ন থেকে যায় যে, কি কারনে কাঠবিড়ালি নিয়ে এত কম গবেষণা?
একটু গভীরে খোঁজার সাথে সাথে বের হয়ে আসতে শুরু করল আমাদের দেশের সংবিধানের দুর্বল কাঠামো, অস্পষ্ট, ত্রূটিপূর্ণ আইন ও নীতিমালা যেগুলো রাজনৈতিকভাবে এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রকল্প পরিচালনা পদ্ধতি যা কিনা আন্তর্জাতিক সহায়তার উপর প্রচণ্ডভাবে নির্ভরশীল এবং অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত এবং সেই সাথে এটি সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীভূত সংস্থাগুলোর উপরও। তাছাড়া আমাদের দেশের প্রায় সব বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রকল্পের, এমনকি গবেষণার আর্থিক সহায়তাও আসে আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে যেখানে বন অধিদপ্তরও এই আর্থিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণীর উপর যে পক্ষপাতিত্ব তা গবেষণা বা প্রকল্পে তাদের ইচ্ছানুযায়ী শর্তারোপণেই দৃশ্যমান।
আন্তর্জাতিক সংস্থা স্থানীয় মানুষদের যারা কিনা অংশীদার তাদেরকে বিভিন্ন প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করলেও সেইসব প্রকল্পে স্থান ভেদে সেই জায়গার মানুষের চিন্তাধারা, বিশ্বাস,সামাজিক, আর্থসামাজিক, সামাজিক বাস্তুসংস্থান এই দিকগুলো বিবেচনা না করে বরং তাদের গতানুগতিক কার্যক্রমই অনুসরণ করে থাকে। তাই কোন সমস্যার সমাধান করলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়না। এবার আসা যাক আর্থ-সামাজিক,সামাজিক সমস্যায় এবং তা কিভাবে অন্যান্য সমস্যার সাথেও জড়িত।নগরায়ন,কৃষি জমির বৃদ্ধি,জনসংখ্যা বৃদ্ধি কাঠবিড়ালী বাসস্থান দিন দিন ধংস করে ফেলছে যার ফলে কাঠবিড়ালী না চাইলেও মানুষের সাথে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে যাতে করে কৃষকদের ফসলী ও আবাদি জমি নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া কিছু অসাধু ব্যাবসায়ীদের চোরাচালানের মাদ্ধমে কাঠবিড়ালি ছড়িয়ে পড়ছে দেশের অবাঞ্ছিত কিছু অঞ্চলে। এসব বিভিন্ন কারণ একসাথে হয়ে বাংলাদেশের কাঠবিড়ালী ফসলের জন্য ক্ষতিকারক প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে সেই ১৯৮০ সাল থেকেই।এইজন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো স্থানীয় এই ক্ষুদ্র প্রাণীটিকে রক্ষা করা ও এর গবেষণায় আর্থিক সাহায্য প্রদানকে প্রয়োজনীয় মনে করেনি। আর যেহেতু আমাদের সব সরকারি নীতিমালাই উন্নয়নকে ঘিরে তাই যখন কাঠবিড়ালী আর উন্নয়নকে বেছে নেয়ার সময় আসে তখন সবসময় উন্নয়নকেই বেছে নেয়া হয়। আর অপ্রিয় সত্যি হচ্ছে, আর্থিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল গবেষকরা, বাধ্য হয়ে হোক বা অনীহা থেকেই হোক, আন্তর্জাতিক বিপন্ন প্রানীকেই বেশি প্রাধান্য দেয় যাতে তারা আর্থিক সহায়তা ও তাদের কাজের স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত না হয়।
কিন্তু কথা হচ্ছে এত সমস্যা নিয়ে এই কাঠবিড়ালী আমরা কেন বাঁচাবো ?! কারণ প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণী পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কাঠবিড়ালি কি ভূমিকা পালন করছে? কাঠবিড়ালীর খাদ্যতালিকায় ফল,সবজি ও কিটপতঙ্গ অন্যতম। যেখানে আমাদের দেশে দিন দিন বন ও গাছ-পালা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, কাঠবিড়ালি সেখানে পরাগায়ন ও শাক-সব্জির বীজ ফেলে প্রাকৃতিক বৃক্ষায়নের কাজ করছে। তাছাড়া অনেক ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ ও তাদের ডিম খেয়ে কাঠবিড়ালী বিনা মুল্যে ক্ষতিকারক পোকামাকড় থেকে আমাদের ফল ও ফসল বাঁচাচ্ছে যার কারণে কীটনাশকের মত বিষাক্ত জিনিস আমাদের খাবারে ব্যবহার করার দরকার হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে কাঠবিড়ালি এই কীটপতঙ্গের অবাধ বংশ বিস্তার রোধ করে আমাদের অনাকাঙ্খিত ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের ঝুঁকি কমাচ্ছে যার অন্যতম উদাহরন হচ্ছে কৃষিক্ষেত্রে ‘পঙ্গপালের’ আক্রমণ। আফ্রিকা দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছে তাদের কৃষিক্ষেত্রে ‘পঙ্গপালের’আক্রমণের কারনে যা কিনা বাংলাদেশও অতিশীঘ্রই হবার সম্ভবনা আছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
কিন্তু গবেষণার প্রয়োজন কি? গবেষণা কোন অজানা তথ্যকে বের করে এনে আমাদের তা জানতে সহায়তা করে। গবেষণা সকলদিক বিবেচনা করে সব ছড়ানো ছিটানো তথ্য, সমস্যা ও সমস্যাগুলোর পিছের কারন একসাথে করে সমস্যার সমাধান বের করে আনতে সহায়তা করে। এই বের হয়ে আসা সমাধান ব্যবহার করেই নীতিনির্ধারকরা বলিষ্ট নীতিমালা করার সুযোগ পায়। তাই যত বেশি গবেষণা হবে তত উপযোগী, বলিষ্ঠ, ত্রুটিহীন নীতিমালা গঠিত হবে।
আমার গবেষণায় যে চারটি পরিকল্পনা পদক্ষেপের প্রস্তাবনা দাওয়া হয়েছে যেগুলোকে বিকল্প নীতিমালা ও বলা যেতে পারে, যা কিনা কাঠবিড়ালী সম্পর্কযুক্ত পরিস্থিতি সংশোধন করার এবং কাঠবিড়ালীর উপর গবেষণা বৃদ্ধি করতে সহায়ক হবে।
প্রথমত, প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য যেসব নীতিমালা এবং আইন রয়েছে সে সব গুলোই নবায়ন করতে হবে।নীতিমালা ও আইন গুলো শুধু মাত্র উন্নয়নকে ঘিরেই নয় বরঞ্চ বাস্তুসংস্থান বিষয়ক জ্ঞান,সামাজিক- বাস্তুসংস্থান বিষয়ক জ্ঞান,মানুষের চিন্তা ধারা,বিশ্বাস,মনোভাব এমনকি মাঝে মাঝে দেশীয় জ্ঞানকেও প্রাধান্য দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, সরকারি সংস্থা যেমন, বন অধিদপ্তরে আন্তবিষয়ক (যেমনজীববিদ্যা, নৃতত্ত্ব, বাস্তুসংস্থান, ভূতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, প্রানীর আচরণ ইত্যাদি) উপদেষ্টা প্যানেল গঠন করতে হবে।
তৃতীয়ত, সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত করতে হবে অর্থাৎ শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু ক্ষমতাবান মানুষের হাতেই সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা থাকলে চলবে না বরঞ্চ সাধারন জনগণও যেন এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে । সর্বশেষ কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপটি হল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা বিষয়ক পড়াশোনা শুরু করতে হবে যেখানে শিক্ষার্থীরা পরিবেশ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনার সঠিক যোগসুত্র সম্পর্কে শিখতে পারবে এবং ভবিষ্যতে সবদিক দিয়ে বিবেচনা করে সমস্যার উৎপত্তির কারণ সম্পর্কে এবং তার সঠিক সমাধান বের করার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে। এটা মনে রাখা ভাল যে বিজ্ঞান একা সবসময় সব সমস্যার সমাধান করতে পারে না। যেসব পরিস্থিতিতে সামাজিক,আর্থ-সামাজিক ইত্যাদি সমস্যাগুলো জড়িত তাতে অবশ্যই আন্ত-বিষয়ক গবেষণার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা উচিত। কাঠবিড়ালী বন্য প্রানী হিসেবে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদেরই অন্তর্ভুক্ত এবং কাঠবিড়ালী সম্পর্কিত পরিস্থিতি একাধিক সমস্যার সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে তাই এর সমাধানও দীর্ঘ মেয়াদী এবং বিস্তারিত।আর এই সমাধান বের করার জন্য প্রয়োজন বিস্তারিত ও আন্তবিষয়ক গবেষণা,পরিস্থিতি বিপদজনক মোড় নিয়ে এই ক্ষুদ্র উপকারী প্রানীটি বিলুপ্ত হওয়ার আগেই।
শিক্ষার্থী, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ।
Insightful indeed.