বিংশ শতাব্দীতে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ংকর ও রক্তক্ষয়ী সংঘাতের নাম। আর দুই বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় উত্থান ঘটেছে জাতিপুঞ্জ এবং পরবর্তীতে জাতিসংঘের মত কিছু বৈষয়িক ও অঞ্চলিক সংস্থার।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভয়াবহ দেখে তৎকালীন বিশ্বনেতারা ২৮ শে, এপ্রিল ১৯১৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের ১৪ দফার ভিত্তিতে ‘লীগ অব নেশনস’ গঠন করে। প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে কিছুটা শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হলেও, পরবর্তীতে সংস্থাটির সাথে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্বার্থ জড়িয়ে পড়ার কারণে এটি তার ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়। জাপান যখন মাঞ্চুরিয়া দখল করে, অথবা ইটালি ও জার্মানি যখন সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের নেশায় মেতে উঠে তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ‘লীগ অব নেশনস’ এর ছিল না । বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার যে আশা নিয়ে সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। আর এই ব্যর্থতার জন্য পৃথিবীতে গণতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটে এবং পর্যায়ক্রমে ফ্যাসিবাদী ও নাৎসিবাদী একনায়কতন্ত্রের উত্থান হয়। ফলে বিশ্ববাসীকে ভয়াবহ ও নৃশংস বিশ্বযুদ্ধের, দুই কোটি মানুষের প্রাণহানি। জাতিসংঘও কি ওই পথে হাঁটছে!
১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর ১১ টি সম্মেলনে মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তান্ডবলীলার উপর,বিশ্বব্যাপী গনতন্ত্র, মানবাধিকার সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য গঠিত হয় জাতিসংঘ।কিন্তু জাতিসংঘ তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পরেও বেড়েছে দেশগুলোর মধ্যবর্তী হিংসা, বৈষম্য,যুদ্ধ, সংঘাত, দারিদ্র্যতা এবং ক্ষুধাজনিত সমস্যা । উন্নত দেশগুলোর অপরিকল্পিত শিল্পায়ন , লাগামহীন কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমনের ফল,বাড়ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা, সাগরতীরবর্তী দেশগুলো ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে,আর এসকল বিষয়ে জাতিসংঘ কর্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। ইসরায়েল দ্বারা ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত করা, কাশ্মীরিদের স্বাধীনতাহরণ, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর চলমান গনহত্যা ও তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা, মধ্যপ্রাচ্যে উগ্রপন্থী রাজনৈতিক বিকাশ সবকিছুতে জাতিসংঘ এখন নীরব দর্শক ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই, জাতিসংঘের উপর বিশ্ববাসীর অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেরই ধারণা,জাতিসংঘ ব্যবহৃত হচ্ছে বৃহৎ রাষ্ট্র সমূহের আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে। আর এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী করা হচ্ছে বৃহৎ রাষ্ট্রের স্বার্থান্বেষী নীতিগুলোকে। ৭৫ বছরে জাতিসংঘের ব্যাপক সম্প্রসারণ হলেও সময়ের প্রয়োজন অনুসারে কোন সংস্কার আনা হয়নি। সংস্কারের উদ্দেশ্য “কমিশন অন গ্লোবাল গর্ভনেন্স” গঠন করলেও তা বেশি দূর অগ্রসর হয়নি।
বিশেষত প্রশ্ন উঠেছে, শক্তিধর দেশগুলোর ভেটো দানের ক্ষমতা নিয়ে। কারণ, যখনই জাতিসংঘে এই বৃহৎ পাচঁটি রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে প্রস্তাব এসেছে তখনই এরা নিজেদের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে সেই প্রস্তাবকে বাতিল করে দিয়েছে। অতএব, জটিলতা নিরসনে বিশ্বের আরও কিছু দেশকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য বানানো উচিত ।ইতিমধ্যেই ভারত, জাপান, জার্মানি, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশ নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য হবার জন্য আন্দোলন করছে। অবশেষে, বিশ্ব চলমান সংঘর্ষ বন্ধে ও বিশ্বকে নতুন কোন বিপর্যয়ের হতে থেকে রক্ষা করতে, এই সংস্থাকে একবিংশ শতাব্দীর চাহিদা অনুসারে সংস্কার করা হোক।
শিক্ষার্থী, চট্রগ্রামবিশ্ববিদ্যালয়