জার্মানি রাষ্ট্রনায়ক এডলফ হিটলার ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সূত্রপাত হয়। এই মহাযুদ্ধ ইতিহাসে উপনিবেশ শাসন পতনের প্রধান বাহক হিসাবে গণ্য করা হয়। কেননা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং এশিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে তাদের উপনিবেশ শাসন পতনের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ শাসন চুড়ান্তভাবে পতন হলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের কর্তৃত্ব অবসান হয়। একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া (সোভিয়েত ইউনিয়ন) নতুন পরাশক্তি হিসাবে বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। আমেরিকার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক তথা পুঁজিবাদ ব্লক ও রাশিয়ার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বোলায় তথা কার্ল মাক্সের সাম্যবাদ দর্শন প্রতিষ্ঠা করে। উভয় দেশ বিশ্বব্যাপী নিজেদের প্রভাব অব্যাহত রাখতে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, পরোমাবিক এমনকি মহাকাশ যুূদ্ধের মতো ভয়াবহ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। এ পেক্ষাপটে স্নায়ু যুূদ্ধের সূত্রপাত হয়। এই যুূদ্ধ স্থায়ী কালছিল ৫০ দশক থেকে ৯০ দশক পর্যন্ত। স্নায়ু যুদ্ধ মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্য আদর্শ গত দ্বন্দ্ব যা বিশ্বকে দুইটি শিবিরে বিভক্ত করেছিল।
৮০ দশকের শেষদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নেতৃত্ব সংকট পড়ে, বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক প্রতিযোগীতায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পরাজিত হয়। এর ফলে সোভিয়েত ভেঙ্গে যায় এবং ওয়াশিংটন বিশ্বব্যাপী একক পরাশক্তি হিসাবে ছড়ি ঘুড়াতে থাকে। পুঁজিবাদী আদের্শের কাছে সমাজতান্ত্র আদর্শ পরাজিত হওয়ার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী টারগেট হয়ে ওঠে মুসলিম বিশ্ব তথা মধ্যপ্রাচ্য। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত অধ্যাপক স্যামুয়েল পি হান্টিংটনের “The clash of Civilization ” বা সভ্যতার সংঘাত, এই তত্বে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, যে সোভিয়েত পতনের মধ্য দিয়ে পৃথিবিতে স্থায়ী ভাবে শান্তি আসে নাই। এখন থেকে সংঘাত সৃষ্ট হবে এক সভ্যতার সঙ্গে অন্য এক সভ্যতার। তাঁর মতে, পৃথিবিতে বর্তমান আটটি সভ্যতা চলমান যথা মুসলিম সভ্যতা, ওয়েস্টার্ন বা পশ্চিমা সভ্যতা, কানফুসিয়ান তথা চীনা সভ্যতা, হিন্দু সভ্যতা, জাপানি সভ্যতা, স্লাবিক-অর্থোডক্স সভ্যতা বা সাবেক সোভিয়েত দেশগুলো, লাতিন আমেরিকান সভ্যতা ও আফ্রিকান সভ্যতা। সোভিয়েত পরবর্তী এই সভ্যতা গুলোর মধ্য পশ্চিমা ও মুসলিম সভ্যতার মধ্য সংঘাতের সূত্রপাত হবে, এমন ধারণা ব্যক্ত করেছিলেন।
হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘাত তত্বটি প্রথম দিকে তেমন সাড়া না ফেললেও ২০০১ সালে ওসামা বিন লাদেন কর্তৃক আমেরিকার টুইন টাওয়ার্সের হামলার পর থেকে তত্বটি বেশি গুরুত্ব পায়। টুইন টাওয়ার্স হামলা বা নাইন ইলেভেনের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা ও মুসলিম সভ্যতার সংঘাত স্পষ্ট হয় যা আজ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। নাইন ইলেভেন সূত্রধরে প্যান্টাগান আফগানিস্তানে হামলা করে তালেবান সরকার পতন এবং কাবুলে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত অব্যাহত রেখেছে। এদিকে ইরাকে গণবিধ্বস্ত্র অস্ত্র ও জনগনের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন যৌথভাবে ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করে। প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের ক্ষমতাচ্যুত এবং ইরাকের তেল সমৃদ্ধ অঞ্চল পশ্চিমা দখল ভুক্ত হয়। শুধু ইরাকে নয় সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য তেল সম্পদের ওপর আমেরিকার শকুনের মতো দৃষ্টি যা সৌদি রাজতান্ত্রকে হাতে রেখে সমগ্রহ মুসলিম বিশ্বে ওয়াশিংটন সংঘাতের দাবার চাল চেলেছে।
আরব বসন্তে তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিশর, ইয়েমেন ইত্যাদি দেশের সরকার পতন হয়। এর পিছনে প্যান্টাগানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সমর্থনে পাশাপাশি সামরিক সাহায্য করেছিল। আরব বসন্তের ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা শক্তির স্বার্থ হাসিলের পাশাপাশি অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যে পাকাপোক্ত করেছে এই সংঘাত। ইসরাইল, আরব আমিরাত ও বাহরাইন সঙ্গে যতটা শান্তি স্থাপিত করেছে ঠিক ততটা সংঘাতে জড়িয়েছে ইরান বোলায়ের সঙ্গে যা ফিলিস্থিনীদের অধিকার আদায়ে তেহেরান এক বিন্দু ছাড় দিবেনা।
আরও পড়ুনঃ দক্ষিণ এশিয়াতে চীনের আধিপত্য
১৯৭৯ সালে ইরানে “ইসলামিক বিপ্লব” এর পরে আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধ সত্ত্বেও নিজস্ব প্রযুক্তি, সমরাস্ত্র (বিশেষ করে মধ্য-পাল্লা ও দূর-পাল্লা ক্ষেপান্নাস্ত্র) , রাজনৈতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান শক্তিশালী দেশ হিসাবে জানান দিয়েছে এতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু সৌদিআরব তার রাজতন্ত্র রক্ষায় ওয়াশিংটনের সংঘবদ্ধ হয়ে মুসলিম বিশ্বে যেভাবে ভয়ঙ্কর তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে যা মুসলিম বিশ্ব আজ সংঘাত, জঙ্গি তৎপরতা, সন্ত্রাসী কার্যেসংঘটিত হয়েই চলেছে । এছাড়া ইয়েমেনের ওপর সৌদিআরবের চাপিয়ে দেয়া যুূদ্ধ এবং ফিলিস্থিনির প্রতি নিবার্ক ভূমিকা স্পষ্ট হয় যে আমেরিকার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে সৌদিআরবের কিছুই করার নাই। তবে সিরিয়া প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় ও রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্যে শক্ত অবস্থান ইরানকে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে আরো অসংযত করেছে। এদিকে ইরাক সিরিয়া ও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট যে এই অঞ্চলে প্যান্টাগানের স্বার্থ হ্রাস পেয়েছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্থিনিদের অধিকার যতদিন পর্যন্ত আদায় না হবে ততদিন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির সুবাতাস কখনো আসবে না।
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়